‘রো’ থেকে মি. বিন যেভাবে!

মি. বিন! এই নাম শোনেননি বা তাকে চিনেন না এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। মি. বিন নামে পরিচিত মানুষটি সারাবিশ্ব জুড়ে চিরচেনা। তার হাস্যরস বোঝার জন্য কোনো শিক্ষার দরকার নেই। 

আজ থেকে প্রায় ২৯ বছর আগে বিট্রিনের টিভিতে প্রথম প্রচার হয়েছিল জনপ্রিয় কমেডি শো মি. বিনের প্রথম পর্ব। পরবর্তীতে এই মি. বিন পরিণত হয়েছিল পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। তবে মানুষ হাসানোর এই কারিগর সর্ম্পকে আমরা কতটুকুই জানি? তাই আজকে আমরা নানা প্রতিকূলতার মাঝে একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার জানা-অজানা তথ্যগুলো সর্ম্পকে জানবো।

মি. বিনের আসল পরিচয়
মি. বিন এর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো সিরিজ, ছোট পর্ব এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার সব কটিতেই ধারাবাহিক এবং সর্ম্পূণ অপরিবর্তিত থেকে অভিনয় করে গেছেন ব্রিটিশ অভিনেতা ও লেখক ‘রোয়ান অ্যাটকিনসন’! অসামান্য প্রতিভাবান এই অভিনেতার পুরো নাম ‘রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন’ আর ডাকনাম ‘রো’। তুঙ্গ-স্পর্শী জনপ্রিয় অ্যাটকিনসন ইংল্যান্ড এর কনসেট কাউন্টি ডারহামে ১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে চার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন অ্যাটকিনসন। তার বাবার নাম ছিল এরিক অ্যাটকিনসন। যিনি পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। এছাড়াও তিনি ছোট একটি কোম্পানির দেখাশোনা করতেন আর মায়ের নাম ছিল এলা মে। তার তিন ভাইয়ের এক ভাই ‘পল’ খুব ছোট থাকতেই মারা যায়, ‘রোডনী’ একজন অর্থনিতীবিদ এবং অন্যজনের নাম ‘রুপার্ট’।

অভিনয় ছাড়াও অ্যাটকিনসন এর আরো কিছু গুনাবলি
অ্যাটকিনসন পড়াশোনায়ও ছিলেন দারুন মেধাবী ও প্রচন্ড পরিশ্রমী! তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু করেন ডানহ্যামের কোরিষ্টার্স স্কুলে, এরপর সেখান থেকে যান সেন্ট বিস স্কুলে। নিউ ক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৫ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রি নেন এবং একই বিষয়ে কুইন্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ২০০৬ সালে সম্মানজনক ফেলো ডিগ্রী অর্জন করেন।

টিভি অনুষ্ঠান আর চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে মানুষের মন জয় করলেও অ্যাটকিনসন শুরুর দিকে কিন্তু লেখালেখি করেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার লেখা কমেডি ধারার দুটি বই ‘নট দ্য নাইট’ ও ‘ক্লক নিউজ’ দিয়ে ১৯৭৯ এর দিকে বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা পান এবং ব্রিটিশ একাডেমি থেকে জিতে নেন বেশ কিছু পুরষ্কার। পরবর্তিতে এই বইগুলো থেকে টিভি কমিক অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হয় যাতে অভিনয় করেছিলেন তিনি নিজেই।

অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ
ছোটবেলা থেকেই অ্যাটকিনসন হাসিখুশি একজন মানুষ ছিলেন। তবে তিনি কম কথা বলতেন। অ্যাটকিনসনের ডারহামের কাথেড্রাল স্কুলে একটি ফিল্ম সোসাইটি ছিল। সেই ফিল্ম সোসাইটির প্রধান বিষয় ছিল হাসি ও শিশুতোষ বিষয়ক সিনেমা। স্কুলে যখন চার্লি চাপলিনসহ আরো যাদের কমেডি মুভিগুলো দেখতেন তখন থেকেই তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। 

যে কারণে বারবার অভিনয়ের সুযোগ হারিয়েছেন মি. বিন। অক্সর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে অভিনয়ের প্রতি আবারো আগ্রহ জন্মায় তার। তারপর একটি কমেডি গ্রুপে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে তার কথার তোতালামির কারণে তিনি ভালো করতে পারেনি। এরপর অভিনয়ের দিকে মনোযোগ হলে সেখানেও একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। তার তোতলামির কারণে অনেকগুলো টিভি শো থেকে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে ফিরিয়ে দেয়। হতাশায় তার চারপাশ ঘিরে ধরে। এরপরও সে নিজের উপর বিশ্বাস হারাননি।

হঠাৎ একদিন বিনের সঙ্গে পরিচয় হয় রির্চাড কার্টিস নামে একজন নাট্যকার ও গীতিকার অভিনেতার সঙ্গে। রির্চাড কার্টিস ও অ্যাকটিনসনের দুজনে মিলে অক্সর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন ‘অক্সর্ফোড নাট্যশালা’। তারা দুজনে বিবিসি রেডিও থ্রিতে ‘দ্য অ্যাটকিনশন পিপলস’ নামে একটি স্যাটারিক্যাল ইন্টারভিউধর্মী অনুষ্ঠাসে পারর্ফম করতেন। ১৯৮৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পায় অ্যাকটিনসনের অভিনত মুভি `Dead on time’। একই বছরের অক্টোবরে মুক্তি পায় রোয়ান অ্যাকটিনসনের অভিনীত জেমস বন্ড সিরিজের ছবি never say never again মুভিটি। এই মুভিটিতে অ্যাকটিনসন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন।


মি. বিন হিসেবে পর্দায় আগমন
১৯৯০ সালের পহেলা জানুয়ারিতে ‘মি. বিন’ নিয়ে টেলিভিশন পর্দায় হাজির হন রোয়ান অ্যাটকিনসন। মি. বিন মূলত ১৪ পর্বের একটি হাস্যরসাত্নক ব্রিটিশ টিভি ধারাবাহিক। আইটিভি নামক টেলিভিশন চ্যানেলে এর প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়। মি. বিন ছাড়াও তিনি ‘ব্ল্যাকাডার’ ও ‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক নিউস’ নামে দুটি কমেডি স্কেচ শো এবং হলিউড অ্যাকশন কমেডি ‘জনি ইংলিশ’ এর জন্যও সুপরিচিত। তিনি ‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক’ এ দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য ১৯৮১ সালে BAFTA এর নিকট থেকে Best Entertainment Performance পুরষ্কার জিতেন।


তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজ গুলোর মধ্যে আছে ১৯৯৪ সালে অভিনয় করেন ‘ফোর ওয়েডিং এন্ড এ ফুনেরাল’ সিনেমাতে। একই সালে ভয়েস দেন ‘লায়ন কিং’ এ। ২০০৩ সালে একজন জুইয়েলারি বিক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করেন ‘লাভ একচুয়েলি’ সিনেমাতে। থিয়েটারে অসাধারণ অভিনয় করার জন্য ১৯৮১ সালে জিতেন অলিভার অ্যাওয়ার্ড। মি. বিন এর দুটি চলচ্চিত্র আর ইংলিশ ফিল্ম সিরিজ জনি ইংলিশ (২০০৩-২০১৮) দিয়েও তিনি সিনেমাটিক সাফল্য অর্জন করে নেন।


মিস্টার বিনকে অ্যাটকিনসনের বিদায়
২০১২ সালের নভেম্বরে রোয়ান অ্যাটবিনসন ডেইলি টেলিগ্রাফকে বিন চরিত্রে আর না আসার ঘোষনা দেন। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, এ চরিত্রটি তাকে দিন দিন শিমুতে রূপান্তর করে দিচ্ছে। এ চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার জন্য যে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয়, সেটিও তিনি পাচ্ছেন না। এছাড়া তার মতে, একজন পঞ্চাশ ঊর্ধ্বের ব্যক্তিকে শিশুসুলভ অভিনয় করাটা একেবারেই বেমানান। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে সে সিরিয়ালধর্মী চরিত্রগুলোতেই শুধু অভিনয় করবেন।


কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার নেয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। ব্রিটেনের ডেইলি স্টার প্রত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে রোয়ান বলেন, ‘প্রবীণ বলসে আমরা মি. বিনকে নিয়ে কি কি করাতে পারি আর ঠিক কি রকমের হাস্যরস তার থেকে বের করে আসতে পারি সেটা সত্যি বেশ মজার ব্যাপার হবে। আর একজন বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করা হবে আমার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা।

ব্যক্তিজীবনে রোয়ান অ্যাটকিনসন
১৯৯০ সালে রোয়ান অ্যাটকিনসন মেকআপ আটিস্ট সুনেত্রা শাস্ত্রির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বেঞ্জামিন ও লিলি নামে তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে রোয়ান ছিল খুবই চুপচাপ স্বভাবের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে তার ভালো লাগে না। অ্যাটকিনসনের শখ হলো স্পোর্টস কার সংগ্রহ করা। নিজের টেনিস কোটের চারপাশে তার ছোট রেসিং কার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে তিনি অনেক আনন্দ পান। যদিও এটি বলা বাহল্য রোয়ান অ্যাটকিনসন হচ্ছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা সেলিব্রিটিদের অন্যতম।


অ্যাটকিনসনের বিবাহ বিচ্ছেদ
দীঘ দুই যুগ একসঙ্গে সংসার করার পর ২০১৫ সালে রোয়ান অ্যাটকিনসনের সঙ্গে সুনেত্রা শাস্ত্রির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। সংসার ভাঙ্গার কারণ হিসেবে জানা যায়, রোয়ান আবার প্রেমে জড়িয়েছেন। সংসার বিচ্ছেদের জন্য সুনেত্রা লন্ডনের সেন্ট্রাল ফ্যামিলি কোর্টে আবেদন করলে মাত্র ৬৫ সেকেন্ডের শুনানিতে তার আবেদন মঞ্জুর করে আদালত।


জানা যায়, রোয়ান দেড় বছর ধরে লুইস ফোর্ড নামের একজন টেলিভিশন তারকার সঙ্গে ডেট করে আসছেন।


মি. বিনের কিছু অর্জন
২০০৫ সালে রম্য দর্শকের ভোটে ব্রিটিশ কমেডি ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ৫০ কমেডিয়ানদের তালিকায় নাম উঠে রোয়ান অ্যাটবিনসনের। রাজনীতি ও রাজপরিবারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ড্রারহামের ক্যাথেডাল স্কুলে রোয়ানের সঙ্গী ছিলেন টনি ব্লেয়ার (যুক্ত রাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী)।

Post a Comment

0 Comments